বাংলাদেশ | বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ১৮, ২০২৪ | ৪ বৈশাখ,১৪৩১

রাজধানী

15-08-2015 08:30:37 AM

শখ থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন

newsImg

মেশিন পাঠায়া দিছি। পাইছস?

হ ভাই পাইছি। গুলি পাইছি ১৫টা।তাইলে ‘কাম’ সাইরা ফালাইয়া দে তাড়াতাড়ি...জেলখানার চার দেয়ালে বন্দী একজন শীর্ষ সন্ত্রাসী মোবাইল ফোনে এভাবেই কথা বলছিলেন তার সহযোগীর সঙ্গে। মোবাইল ফোনের এমন কথোপকথনের কয়েকদিন পরই তাদের সেই কামহয়ে যায়। রাজধানীর হাজারীবাগে একজন ব্যবসায়ীর লাশ ফেলার মধ্য দিয়ে তাদের সেই কাম হাসিল হয়। যার খবর একইভাবে জেলখানায় আটক ওই শীর্ষ সন্ত্রাসীকে জানানো হয়েছিল। তার সহযোগী শীর্ষ সন্ত্রাসীকে ফোনে বলেন, ফাইনাল, শেষ। একদম পইড়া রইছে।’ জবাবে শীর্ষ সন্ত্রাসী তাকে বলেন, চুপ কর, তুই এখন সইরা যা’। ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের সৌখিন সন্ত্রাসী-খ্যাত ইমন কারাগারের ভিতরে-বাইরে একই রকম। কারাগারের বাইরে যখন ছিলেন, খুন করেছেন একের পর এক। যখন ভিতরে-তখন দিয়েছেন খুনের নির্দেশ। মোবাইল ফোনের এমন নির্দেশের পর লাশ পড়েছিল হাজারীবাগে। র‌্যাব তার মোবাইল ফোনের কথাবার্তা রের্কড করলে বেরিয়ে আসে খুনের নির্দেশের এমন ঘটনা। স্বনামধন্য চিকিৎসক দম্পতির সন্তান ইমন। তার পুরো নাম সানজিদুল ইসলাম ইমন। ধানমন্ডিতে তাদের বাসা। এলাকার বখাটে কিছু ছেলের সঙ্গে মেলামেশা করতে গিয়ে অবৈধ অস্ত্রের সঙ্গে তার পরিচয়। তার শখ হয় নিজের কাছে অস্ত্র রাখার। সেই শখ মেটাতেই টাকা দিয়ে নিত্যনতুন অস্ত্র কিনতে থাকেন ইমন। যখন যার কাছে নতুন কোনো অস্ত্রের সন্ধান পান, তাকেই বলেন অস্ত্র কিনে দিতে। ধীরে ধীরে তার এই অস্ত্রের ভাণ্ডারের সংবাদ চাউর হয়ে যায় আন্ডারওয়ার্ল্ডে। তার শত্রুও বেড়ে যায়। একপর্যায়ে তাকে টার্গেট করে বেশ কয়েকটি হামলার ঘটনা ঘটে। এরপরই মূলত ইমন নিজেকে রক্ষায় শখের সেই অস্ত্র হাতে তুলে নেন। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে শুরু হয় তার অন্যরকম এক সহিংস মিশন। সৌখিন এই সন্ত্রাসী একসময় হয়ে ওঠেন দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী। সানজিদুল ইসলাম ইমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজকল্যাণে অনার্স ও মাস্টার্স পাস করেন। তার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু হয় ১৯৯৯ সালে ধানমন্ডি এলাকার গালকাটা জব্বার নামে এক প্রতিবেশীর সঙ্গে পারিবারিক দ্বন্দ্বের জের ধরে। পরে তিনি হয়ে ওঠেন ধানমন্ডি এলাকার ত্রাস। পর্যায়ক্রমে ইমনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পরিধি বিস্তৃত হয় ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, রমনা, বাড্ডা, কোতোয়ালি, লালবাগ, উত্তরা, তেজগাঁও ও হাজারীবাগ এলাকায়। তার বিরুদ্ধে নগরীর বিভিন্ন থানায় ৩০টির বেশি হত্যা মামলা রয়েছে। যার মধ্যে চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী ও আওয়ামী লীগ নেতা মঞ্জুরুল ইসলাম অশ্রু হত্যাকাণ্ড রয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, একসময় মোহাম্মদপুরের একটি বাহিনীর সঙ্গে ইমনের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। ওই বাহিনীর সঙ্গে থেকে হিমেল, পলাশ, মার্ডারসহ বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। ফেরার হয় সমাজের উচ্চপর্যায়ের একটি পরিবারের সন্তান ইমন। আন্ডারওয়ার্ল্ডে তার নিজস্ব বাহিনী গড়ে ওঠে। তার বন্ধু ও সহযোগী মামুনকে নিয়ে গড়ে তোলা এ বাহিনীর নাম হয় ইমন-মামুন গ্রুপ। চাঁদাবাজি, খুনসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েন তারা। ভাড়াটে হিসেবে তারা খুন-খারাবি শুরু করেন। এ বাহিনীর ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত থাকতে হতো আন্ডারওয়ার্ল্ডের অন্যসব বাহিনীকে। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা ইমনকে সমীহ করতেন। তাকে দিয়ে বিভিন্ন কাজ করিয়ে নিতেন। বিশেষ করে দেশের একজন আলোচিত-সমালোচিত বিতর্কিত ব্যবসায়ী যিনি দেশের বাইরে থাকেন, সেই ব্যবসায়ীর অন্যতম ক্যাডার ছিলেন এই ইমন। তার হয়ে চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরীকে গুলি করে হত্যা করেন। সূত্র জানায়, ইমন বিয়ে করেন তার বন্ধুর বোনকে। তার শ্বশুরবাড়ি যশোরে। এমন একটি সময় গেছে, যখন খুন-খারাবি ছাড়া ইমন যেন আর কিছুই ভাবতে পারতেন না। শ্বশুরবাড়ি যশোর গিয়েও তিনি খুন করে এসেছেন। নিছক পাশের বাড়ির লোকজনের সঙ্গে তর্কবিতর্কের কারণে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আফতাব আহমেদ হত্যাকাণ্ডেও জড়িত রয়েছেন এই ইমন। এ ছাড়া কারাবন্দী জোসেফের ভাই টিপুসহ দুই খুনেও ইমন জড়িত বলে পুলিশ জানায়। 

 

সর্বশেষ খুনের নির্দেশনা : ২০১৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর দুপুরে হাজারীবাগ তিন মাজার মসজিদের সামনে প্রকাশ্যে গুলি করে হাজারীবাগের ট্যানারি ব্যবসায়ী আফজাল হোসেন সাত্তারকে হত্যা করা হয়। সাত্তার রাজধানীর ৪৮ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সাবেক সভাপতি ছিলেন। তার বিরুদ্ধেও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ ছিল। এর আগে কারাগারে বসে সাত্তারকে খুন করান বন্দী শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন। প্রায় এক মাসের পরিকল্পনায় তিনি ভাড়াটে খুনি ব্যবহার করে এ হত্যাকাণ্ড ঘটান। কারাগারে বসেই ইমন তার সহযোগীদের সঙ্গে দিনের পর দিন দীর্ঘ সময় ধরে মোবাইল ফোনে হত্যাকাণ্ডের ছক আঁকেন।  ইমন ও তার সহযোগীদের মোবাইল ফোনের কথোপকথনের সূত্র ধরে সাত্তার খুনে ইমনের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তা ছাড়া হত্যাকাণ্ডের পর ইমনের সহযোগী বুলু ও মাসুদকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। জিজ্ঞাসাবাদে ইমনের পরিকল্পনায় কীভাবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তার বিস্তারিত খুলে বলেন বুলু।সূত্র জানায়, সাত্তার সে সময় বুঝতে পেরেছিলেন তার জীবন হুমকির মধ্যে রয়েছে। এ কারণে তিনি বাড়ি থেকে বাইরে  বের হওয়া প্রায় বন্ধ করে দেন। আর এতে অপেক্ষা করতে করতে অস্থির হয়ে পড়েন ইমনের সহযোগীরা। হত্যাকাণ্ডের তিন দিন আগে ইমন কারাগার থেকে কিলিং মিশনের সর্বশেষ নির্দেশনা দেন।ওই কথোপকথন ছিল নিুরূপবুলু : ভাই, স্লামালেকুম।ইমন : বল, কি খবর, ওই (সাত্তার) কি বাইর হইছে।বুলু : না ভাই। কি করন যায় কন দেহি।ইমন : চুপ থাক। একটা লোক ৫ দিন ঘরে থাকতে পারে কিন্তু ৬ দিনের দিন সে বাইর হইবই।বুলু : অগোরে (ভাড়াটে কিলার) তো বাড়ির আশপাশে খাড়া কইরা রাখছি।ইমন : মেশিন পাঠায়া দিছি। পাইছস।বুলু : হ ভাই পাইছি। গুলি পাইছি ১৫টা।ইমন : তাইলে কামডা সাইরা ফালাইয়া দে তাড়াতাড়ি।এরপর ১৪ ডিসেম্বর সাত্তারকে খুন করে ইমনকে আনন্দের সংবাদ জানান কিলার বুলু।এ সময়ের কথোপকথন ছিল-বুলু : ভাই,ইমন : হুবুলু : ফাইনাল, শেষ।ইমন : ঠিক আছে।বুলু : একদম পইড়া রইছে।ইমন : চুপ কর, তুই যাইছ না।২০০০ সালের শেষ দিকে গ্রেফতার এড়াতে ইমন ভারতে আত্মগোপন করেন। ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকার গঠনের পর দেশে ফেরেন ইমন। আবার শুরু হয় তার সন্ত্রাসী তৎপরতা। তবে ২০০৫ সালে র‌্যাবের ক্রসফায়ারের ভয়ে আবার ভারতে পালিয়ে যান ইমন। পরবর্তীতে ২০০৭ সালের শেষ দিকে সিআইডির সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহ আরেফের (বর্তমানে পুলিশ সুপার) নেতৃত্বে একটি টিম ইমন, তাজ, ইব্রাহিম, লম্বু সেলিমসহ সাত সন্ত্রাসীকে দেশে  ফেরত আনে। এরপর থেকে ইমন কারাগারে রয়েছেন। কিন্তু কারাবন্দী থেকেও থেমে নেই ইমনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড।

খবরটি সংগ্রহ করেনঃ- আই-নিউজ২৪.কম
এই খবরটি মোট ( 2835 ) বার পড়া হয়েছে।
add

Share This With Your Friends